রোনালদিনহো-বিশ্বকাপজয়ী এক অসাধারণ ফুটবল তারকা – শেষ পর্ব

যদি ১ম পর্বটা না পড়ে থাকেন পড়তে পারেন রোনালদিনহো-বিশ্বকাপজয়ী এক অসাধারণ ফুটবল তারকা পর্ব-১

ছোটবেলা থেকেই ওর স্বপ্ন ছিল একদিন অনেক সুনাম হবে খেলোয়াড় হিসেবে, অটোগ্রাফ দিবে, যেকেউ তাঁকে চিনবে। মোটামুটি বার্সাতে যাওয়ার পর তাঁর স্বপ্ন অনেকটায় পূরণ হয়েছিল।

২০০৪-২০০৫ঃ

বার্বিকিউ পার্টি, সাম্বা নাচ এবং ছোটবেলার সেই রবিবারের দিনগুলো সে সবসময় মনে করত। আর  রবিবার মানে বার্সেলোনার ম্যাচ। তাই কোন রবিবার ম্যাচ না থাকলে বন্ধু বান্ধবদের আমন্ত্রণ জানাত আর সবার সাথে একসাথে সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করত। বার্সার সব সতীর্থরা তাঁর কাছের মানুষ ছিল,  তৎকালীন  অধিনায়ক পিউল ছিলেন তাঁর বড় ভাইয়ের মত। পিউল ও তাঁকে বন্ধু মনে করত।

জানাইনা মেন্ডিস, রোনালদিনহো এর স্ত্রী তাঁর চোখেমুখের সেই উচ্ছলতার প্রেমে পড়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী একটা টেলিভিশন শো তে নৃত্যশিল্পী হিসেবে কাজ করতেন। সেখানেই তাঁদের দুইজনের পরিচয় ও ভালো লাগার শুরু। এরপর বিয়ে। কিছুদিন পর তাঁদের এক ছেলে সন্তান জন্ম নেয়।

প্রায় টানা ৩-৪ বছর ধরে রিয়েল মাদ্রিদ একেবারে শীর্ষে ছিল। তাঁদের টেক্কা দেয়া অনেক কঠিন ছিল বার্সার জন্য। এই সিজনে বার্সা নতুন করে শুরু করল তাঁদের যাত্রা। সবসময় গোলদাতা অসাধারণ গোল করেন তা কিন্তু নয় মাঝে মাঝে গোলদাতা যিনি তাঁকে দেওয়া পাশ গুলো ও অসাধারণ হয় আর এমন একটা পাশ দিয়েছিলেন রোনালদিনহো ডেকো কে আর ঐখান থেকে ছোট আরেকটি পাশ এবং গোল। কিছুক্ষণ পর রোনালদিনহো পেনাল্টি থেকে ৩য় গোল করলে ৩-০ তে বার্সা বিরাট ব্যবধানে জয় পায় এবং অনেক বছর পর লা লিগা এর শীর্ষস্থান দখল করে। রোনালদিনহো এর ginga স্টাইল বোঝা প্রতিপক্ষের জন্য দূরুহ হয়ে উঠে। এই ধরণের স্টাইলে খেলা খেলোয়াড় খুব কমই পাওয়া যাবে। একের পর এক অসাধারণ গোল, এসিস্ট এই সিজনে এক কথায় অসাধারণ, অবিশ্বাস্য ছিল।

বার্সার বি-দল এ তখন একজন খেলোয়াড় খুব ভালো খেলছিল আর সে হল আর কেউ নয় এখনকার সবচেয়ে বেশি ব্যালন ডি অর বিজেতা লিওনেল মেসি। মূল দলের সাথে মেসি ট্রেনিং সেশনে যখন ডাক পেলেন তাঁর খেলা দেখে রোনালদিনহো বলেছিলেন ম্যানেজম্যান্ট কে আপনারা কি ঠিক আছেন? মেসি কি খারাপ খেলে? তাঁকে মূল দলে আনছেন না কেন? আমার মনে হয় তাঁর আমাদের সাথে মূল দলে খেলা উচিত।

ডাক পাওয়ার পর প্রথম যখন মেসি যোগ দিল মূল দলের সাথে সে খুবই চুপচাপ ছিল, বলতে গেলে লাজুক একটা ছেলে। জুনিয়র খেলোয়াড়দের সাথে বসে সব পর্যবেক্ষণ করত, কথা কম বলত। সর্বপ্রথম সিনিয়রদের মধ্যে রোনালদিনহো গিয়ে মেসির সাথে কথা বলেন।

মেসির সাথে রোনালদিনহো এর সম্পর্কটা সিনিয়র জুনিয়র ছিল না, ছিল বন্ধুত্বের যার কাছ থেকে অনেক কিছুই শিখেছেন তিনি বিশেষ করে কিভাবে শান্ত থাকতে হয় সেই বিষয়টা। মেসি যখন তাঁর প্রথম ম্যাচে পরিবর্তী খেলোয়াড় হিসেবে নামে এর আগেই রোনালদিনহো বলেছিলেন তাঁকে “আমি নিশ্চিত, তুমি আজ গোল করবেই”।  এবং তাই হলো রোনালদিনহো এর সুন্দর একটি পাস থেকে মেসি গোল করেন কিন্তু সেটি ছিল অফসাইড, ফলে গোলটি বাদ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার সেই একেই মানুষের পাসে মেসি তাঁর প্রথম গোল করেন। মেসি নিজেই বলেছেন সেই সময় মাঠে আসলে অনেক অপশন ছিল বলটি দেওয়ার কিন্তু রোনালদিনহো তাকেই বলটা দিয়েছিলেন গোল করার জন্য এবং তিনি সফল হয়েছিলেন।

পুরো সিজনে রোনালদিনহো এর এতো অসাধারণ গোল আর এসিস্ট ছিল অবশেষে ছয় বছর পর বার্সা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।

রোনালদিনহো এমন একজন ছিলেন যিনি হৈ হুল্লোড় পার্টি আড্ডা ছাড়া থাকতেই পারতেন না। তিনি কখনো একা থাকতেই পারতেন না। রোনালদিনহো এর দেওয়া পার্টিতে কেউ গেলে এটাই মনে করত যে এটা তাঁর সেরা পার্টির মধ্যে একটি, বার্সার ম্যানেজম্যান্ট এর কয়েকজন এটায় মনে করেন। তাঁর এই ধরণের জীবনযাত্রা অনেকেই পছন্দ করত না যার জের ধরে তাঁদের ছেলের যখন বয়স ৮ মাস তাঁদের দুইজনের ডিভোর্স হয়ে যায়। রোনালদিনহো তাঁর ক্যারিয়ারকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি চাইতেন ফুটবলের সাথে নিজেকে বেশিরাভাগ সময় রাখতে। ক্যারিয়ারের এই সেরা সময়ে একের পর এক জিতাতে থাকে বার্সাকে। তাঁর খেলার মাধ্যমে তিনি প্রতিপক্ষের সমর্থকদের ও মন জিতে নিয়েছিলেন। দেখা যায়, তাঁর প্রতিপক্ষের সমর্থকরা হারার পরও রোনালদিনহোকে হাততালি দিয়ে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন। সম্ভবত এই লোভ, এত মানুষের সম্মান-ভালোবাসা পাওয়ার লোভই ছিল তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ এর মূল কারণ। সেই সময়কার সতীর্থরা মনে করেন তিনি খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে বার্সার অনেক উপরে নিয়ে গিয়েছিলেন- বিশ্ব সংস্কৃতির পরিচায়ক হয়ে উঠেছিলেন। ২০০৫ এ ব্যালন ডি অর টাও নিজের নামে করে নেন ২০০২ বিশ্বকাপজয়ী এই তারকা। এরই সাথে বার্সাও ২য় বারের মত লা লিগা এর চ্যাম্পিয়ন হয়।

২০০৬ঃ

অসাধারণ নৈপূণ্যে বার্সা ২০০৬ এ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে ও চ্যাম্পিয়ন হয়। তাঁর এই সফলতায় তাঁর পরিবার ও অনেক খুশি ছিল। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে ২০০৬ এ ব্রাজিল বিশ্বকাপে যায় যা ২০০২ এ শুরুর দিকে ছিল না। এই দলে এতো নামকরা ফুটবল ছিল ব্রাজিল এইবার ফেভারিট হিসেবেই খেলতে এসেছিল। ব্রাজিল গ্রুপ পর্ব এবং রাউন্ড অফ ১৬ তে এতোই ভালো খেলেছিল যে অনেকেই বলছিল মনে হয় এবারও তাঁরা বিশ্বকাপ জিতবে। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয় সেই  ১৯৯৮ এ ফাইনালে হেরে যাওয়া ফ্রান্সের সাথে। জিনেদিন জিদান ২য় বারের মত ব্রাজিলের স্বপ্নভংগ করে এবং ব্রাজিলের বিদায় নিশ্চিত করে। জিনেদিন জিদানের ফ্রি কিক পাস থেকে গোল করেন হেনরি। শেষের দিকে রোনালদিনহো একটি ফ্রিকিকের সুযোগ পেলেও কাজে লাগাতে পারে নি এবং হেরে যায় ব্রাজিল। সে চিরাচরিত রূপে ফেরত আসে সমর্থকরা। ব্রাজিলের সব খেলোয়াড় এবং রোনালদিনহোকে বিভিন বাজে কথা বলতে থাকে। রোনালদিনহোকে ভালোবেসে তৈরি করা মূর্তি ভেংগে ফেলে ব্রাজিলের সাপোর্টাররা। এরপর থেকে রোনালদিনহো ভেংগে পড়ে মানসিকভাবে যা তাঁর খেলায় প্রভাব পড়তে শুরু করে, ক্লাব ফুটবলে ও সে খারাপ খেলা শুরু করে। ঠিক এই সময় থেকে মেসি বার্সাকে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং ধীরেধীরে রোনালদিনহো এর বার্সাযুগের অবসান ঘটে মেসিযুগের শুরু হয়।

১ম পর্বটি পড়তে ক্লিক করুন রোনালদিনহো-বিশ্বকাপজয়ী এক অসাধারণ ফুটবল তারকা পর্ব-১

Share

One thought on “রোনালদিনহো-বিশ্বকাপজয়ী এক অসাধারণ ফুটবল তারকা – শেষ পর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Proudly powered by WordPress | Theme: Lean Blog by Crimson Themes.